সর্বশেষ গুরুত্বপুর্ণ খবর

ভারতীয় ফুটবল টিম নির্বাচনে জ্যোতিষীর পরামর্শ

ভারতীয় ফুটবল টিম নির্বাচনে জ্যোতিষীর পরামর্শ, পারিশ্রমিক ১২ থেকে ১৫ লাখ
ভারতীয় ফুটবল টিম নির্বাচনে জ্যোতিষীর পরামর্শ

ভারতীয় ফুটবল টিম নির্বাচনে জ্যোতিষীর পরামর্শ, পারিশ্রমিক ১২ থেকে ১৫ লাখ

যে কোনও খেলায়, টিম নির্বাচন করে থাকেন কোচ, নির্বাচক প্যানেল। সঙ্গে অবশ্যই অধিনায়ক থাকেন। তবে গত বছর ভারতের জাতীয় ফুটবল দলে কারা খেলবেন, তা না কি ঠিক করে দিচ্ছেন একজন জ্যোতিষী! পারিশ্রমিক হিসেবে তিনি পাচ্ছেন ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা।

কিন্তু সত্যিই কি একজন জ্যোতিষী খেলোয়াড় নির্বাচন করে দিতে পারেন? যুক্তিবাদীরা বলছেন, খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়া উচিত তার পারদর্শিতার ওপরে নির্ভর করে। জন্ম সময়, ঠিকুজি ইত্যাদি লক্ষণ ‘শুভ’ হলে তবেই জাতীয় দলে জায়গা পাবেন, এই ভাবনা অযৌক্তিক এবং অনাধুনিক।

তবে খেলোয়াড় এবং ক্রীড়া সাংবাদিকরা বলছেন, ক্রীড়া মহলে বহু ধরণের কুসংস্কার রয়েছে বহু কাল ধরেই, এবং ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলের মতো মঞ্চেও এরকম কুসংস্কারের ছবি দেখা যায়। মূলত আফ্রিকার দেশ এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে এধরণের কুসংস্কার খুব বেশি দেখা যায় বলে জানাচ্ছেন তারা।

ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে ২০২২ সালের মে জুন মাসে এএফসি এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের ম্যাচ চলাকালীন ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচের সঙ্গে দিল্লির এক জ্যোতিষীর প্রায় একশোটি মেসেজ আদানপ্রদান হয়েছে, যাতে লেখা হয়েছিল, ১১ই জুনের এই তালিকার খেলোয়াড়দের প্রত্যেকের চার্টগুলি দেখে নিন।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওই জ্যোতিষী উত্তর পাঠান। কারও সম্বন্ধে, 'ভালো' কারও 'খুবই ভাল করার সম্ভাবনা আছে', অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বর্জন করতে হবে'। কারও সম্বন্ধে লিখেছেন, তার জন্য খুবই ভালো দিন, কিন্তু বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে, আবার কারও সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এদিনের জন্য সুপারিশ করা যাচ্ছে না’

জানা যাচ্ছে, ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব কুশল দাস এই জ্যোতিষীর সঙ্গে মি. স্টিমাচের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন।

সংবাদ সংস্থা পিটিআই ভারতীয় দলের এক সদস্যকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে যে প্রায় ১৬ লক্ষ ভারতীয় টাকার বিনিময়ে জ্যোতিষীর পরিষেবা নেওয়া হয়েছিল।

ক্রীড়াপ্রেমীদের একটা অংশ এবং যুক্তিবাদী সংগঠনগুলি প্রশ্ন তুলছে একজন খেলোয়াড় তো নির্বাচিত হবেন তার দক্ষতার ওপরে ভিত্তি করে, সেখানে তার ঠিকুজি-কুষ্ঠি আসবে কেন?

পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ বলছেন, বর্তমানে ক্রীড়া-বিজ্ঞান যে উচ্চতায় পৌঁছিয়ে গেছে, সেখানে একজন খেলোয়াড়কে তার জন্ম সাল, তারিখ সময় ইত্যাদির ওপরে নির্ভর করে নির্বাচন করা হবে, এটা মানা যায় না। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ মহাপাত্র বলেছেন, “একদিকে যখন বিজ্ঞান মনস্কতার জন্য আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি, তখন দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞান মনস্কতা যাতে তৈরি না হয়, সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিছু মানুষ।

সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারি বিভাগও এর মধ্যে যুক্ত হয়ে পড়ছে। এই ঘটনার ধিক্কার জানানো ছাড়া অন্য কিছু কি বলা যায়?

ক্রীড়া-প্রেমী ও শিক্ষক অয়ন চক্রবর্তীর কথায়, “আমরা যখন জি টুয়েন্টি সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছি, আবার গণেশ ঠাকুরের হাতির মতো মাথাটা নাকি আদিকালে প্লাস্টিক সার্জারির নিদর্শন এসবও বলা হচ্ছে। একই ভাবে আমরা ফুটবলে সামনের দিকে এগোনোর চেষ্টার মধ্যেই জ্যোতিষীকে দিয়ে টিম সিলেকশন করাচ্ছি। আমরা যে আসলে কোথাও এগোচ্ছি না, পিছিয়েই যাচ্ছি, তার প্রমাণ হল এই ঘটনা।

যদিও ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তারা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমকে ‘এখনই কিছু বলা হবে না’।

তবে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনটি সামনে আসার পরে মুখ খুলেছেন ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচ নিজেই।

বিষয়টি নিয়ে তিনি সব তথ্য সামনে আনবেন খুব শীঘ্রই এমন কথা লিখেছেন সামাজিক মাধ্যম এক্সে (পূর্বতন টুইটারে)।

মি. স্টিমাচ এও বলছেন যে ওই সব তথ্য সামনে এলেই বোঝা যাবে যে, কতটা এবং কে এই দেশের ফুটবলের জন্য যত্ন নেয়।

প্রাক্তন জাতীয় অধিনায়ক বাইচুং ভুটিয়া বলছেন ফুটবল মাঠের কুসংস্কার নতুন কোনও বিষয় নয়। ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাতকারে মি. ভুটিয়া বলেছেন, এটা নতুন কিছু নয়। অনেক বিশ্ববিখ্যাত কোচ, বিশেষত আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতে জ্যোতিষীদের খুব মান্য করে।

প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক জানাচ্ছেন, কলকাতার ফুটবলেও মানা হয় এসব (সংস্কার)। খালিদ জামাল বা সুভাষ ভৌমিকরা অন্য দলের গোলপোস্টের কাছে ফুল রেখে দিতেন।

এই সময় কলকাতার সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক রূপক সাহা বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন ফুটবল-খেলিয়ে দেশগুলোর মধ্যে আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকাতে এই কুসংস্কার ভীষণভাবে কাজ করে। এগুলো মূলত আফ্রিকার দেশে প্রচলিত ছিল, সেখান থেকে লাতিন আমেরিকায় গেছে।

তিনি বলছেন, আমি নিজে ওয়ার্ল্ড কাপ কভার করার সময়ে ৯৮ সালের ফাইনালের দিন সকালে একটা ঘটনা দেখেছি। ব্রাজিল আর ফ্রান্স সেদিন ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল খেলবে। হোটেলের নীচে দেখি এক ব্রাজিলীয় দম্পতি কী একটা পোড়াচ্ছে। .... আমি নীচে গিয়ে দেখি ফ্রান্সে সব ফুটবলারদের ছবি পোড়াচ্ছিল তারা। আমি জিজ্ঞাসা করাতে ভদ্রলোক বললেন যে তাদের একটা সংস্কার আছে ছবিগুলো পুড়িয়ে ছাইটা নিয়ে গিয়ে যদি গোলপোস্টের পেছনে রেখে দেওয়া যায় তাহলে ফ্রান্স গোল খেয়ে যাবে, ব্রাজিল জিতে যাবে।

মজার কথা হল, সেবার ফ্রান্সই বিশ্বকাপ জিতেছিল। আসলে প্রত্যেকটা ওয়ার্ল্ড কাপে আফ্রিকার দেশগুলো যে সব ওঝা নিয়ে যায়, তাদের নিয়ে বেশ কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। কিন্তু কোনওবার ওইসব ওঝার মন্তর টন্তর খাটে না।

যেটা লক্ষ্য করার বিষয় তাহলে ঐ সমস্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে দেশের সরকার বা বোট এই ধরনের কুসংস্কারকে প্রমোট করে না। উদ্বেগের বিষয় হলো ভারতের সরকার ও বোর্ড এখন সেটাই করছে। এ পরিণাম হলো, ভারতের জনমানুষ থেকে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতা নষ্ট হয়ে যাবে এবং অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার মাথা ছাড়া দেবে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা।
----------xx----------

Comments